Sunday, October 22, 2017

স্বপ্ন আবার কী?

Article Tag No. #31214
© Abiyad Ahmed


স্বপ্ন আবার কী? 
- আবিয়াদ আহমেদ 



স্বপ্ন দেখে কারা? সাধারণ মানুষ না উঁচু অট্টালিকার ছাদে যারা বড় বড় মিটিং করে তারা? সত্যি হাতের নাকালের বাইরে হলেও অতি বাস্তব চেহারায় ফুটছে বর্তমানের তুবদিগুলো। স্বপ্ন গড়া আর স্বপ্ন পূরণ করা দুটোই মোহে হয়, আবেগ থেকে কিন্তু আমি যে শ্রেণীর স্বপ্ন দেখছি তাদের তো দৈনন্দিন জীবনে কোনো মোহ থাকেনা। তারা স্বপ্ন দেখে সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে রাতের দুইমুঠো অন্ন জোগাড় করার, এই স্বপ্ন কোনো ভাঙা বা গড়ার লড়াই নয়, তাই মোহ আসার প্রসঙ্গই আসেনা। ঘটনার সূত্রপাত কলকাতা এক অতি পরিচিত ঐতিহাসিক স্থান, একটা passion এর দেশ, সেখানেই সংঘর্ষ হয় স্বপ্নদের। এই শহর একটা নমুনা, স্বপ্ন ভাঙার আবার স্বপ্নকে সাজিয়ে তোলার, দুচারটে কথা আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয় - স্বপ্নের আড়ালে কত বেদনা হাসি মুখে ঘুমিয়ে পড়ে সেটা জানতে পারবো। 

শিয়ালদাহ স্টেশন, ভৌগোলিক দিক দিয়ে একটা ভালো গুরুত্ব আছে এই স্টেশনের। কত ক্ষুদে থেকে উচ্চ শ্রেণীর জুতোর ধুলো লেগে আছে এই মেঝেতে।  রোজকার মতই ডাউন শিয়ালদাহ ব্যারাকপুর লোকালের যাত্রী আমি, প্রতিদিনের যাত্রী বলে অনেক মুখোশ আমার চেনা প্রায়। ট্রেনে উঠেই শুরু হলো তাস খেলা, গন্তব্যস্থল প্রায় ৫০ মিনিটের রাস্তা। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে, এই মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে এক মধ্যযুবতী ট্রেন এ উঠলো, যথেষ্ট ভিড় যার ফলে গেটের ধারে নিরাপদ আশ্রয় নিল, আমাদের খেলা আরম্ভ হয়েছে, মেয়েটা নিশ্চুপ বোবা দৃষ্টিতে আমাদের খেলা অনুভব করছে। আমাদের হৈচৈ তারও একটা যেন আনন্দ হচ্ছে, কীভাবে জানিনা, হুট করে তার পায়ের তলা দিয়ে অঝোর ঝরে রক্ত বয়ে আসছে। তখন তেমন কিছুই লোকজন দেখেনি, আমরা কজন মিলে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করি কারণটা, সে জানালো আমার প্রশ্নের উত্তর 'স্বপ্ন আবার কী?'

২১ শে জানুয়ারি ২০১৬ কলকাতার এক নামি কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিলেন, কাজের সূত্রে তাকে থাকতে হয়েছিল প্রত্যন্ত এক গ্রাম্য এলাকার মত পরিবেশে, সেও রোজ অনেকখানি পথ যাত্রা করে অফিসে আসত। প্রয়োজন ছিল বাবার ব্রেইন এর অস্ত্রপাচার করার টাকা জোগাড় করা। স্বপ্ন বুকে বেঁধে হাঁটা দেয় রঙিন শহরের বহুতল অফিসে, অচেনা সহকর্মীদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে কাজের দায়িত্বভার শুরু করেছিলেন ২৩ বছরের মিথি, বাবার সুস্থতায় তার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল হয়তো। মাস খানেক পর তার মাইনের টাকা জোগাড় করে ভেবেছিল একটা ভালো হাসপাতালে বাবার চিকিৎসা শুরু করবে, গরিব ঘরের মেয়ে বহু কষ্টে রোজগার করে ব্যাংক ব্যালান্স খুব সামান্য, নগদ টাকায় অস্বস্তিতে পড়ে রাজনৈতিক নোটবন্দির, ফলপ্রসূত আর সেই টাকা দিয়ে বাবার চিকিৎসা করা হয়ে ওঠেনি তার। আর্থিক অবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে লেগে যায় আর পাঁচ-সাত মাস, অফিসের কাছে কিছু গয়না বন্দক রেখে হাসি মুখে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে "বাবা, আমি মিথি, দেখো আমি অনেক টাকা এনেছি, তোমায় কাল সকালে হাসপাতাল নিয়ে যাবো' আর যাই হউক, বাবার আহ্লাদ যেন খানিকটা হলেও সুস্থ করে দেয় মিথির বাবা মনোরঞ্জন বাবুকে। পরদিন আরম্ভ হয় তাদের অচেনা আবার যাত্রা - ডাক্তারের ইংরেজি ভাষা তাদের বোধগম্য হচ্ছেনা, হাসপাতালের কর্মীদের কেউ বলেছে টেস্ট করুন ডাক্তারবাবু টেস্ট লিখে দিয়েছে, বাবার সুস্থতার অপেক্ষায় আনুমানিক ৩৮,০০০ টাকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায় মিথি। সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টি কর্তার, বিধির বিধান যে ওই মনরঞ্জন বাবুকে সাথ দিলো না, পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী তৎক্ষণাৎ তার অস্ত্রপাচার করতে হবে বলে জানায় চিকিৎসাধীন ডাক্তারবাবু। মিথিকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা জমা দিতে বলে, জমা হলেই বাবার অস্ত্রপাচার আরম্ভ হবে। 

চিন্তার আকাশ মিথির কপালে ভেঙে পড়লো, যে কষ্ট বুকে বেঁধে বাবাকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে কলকাতা এসেছিল কাজের খোঁজে, সেই টাকা দিয়ে বাবার সেবা করা বাবার সুস্থতা হচ্ছে না। এদিকে বাবা শয্যাশায়ী অবস্থায় মিথির কপালে চুমু দিয়ে বলে, "মা - তুই এত টাকা পাবি কোথায়? আমার বয়স হয়েছে আর কতদিন বাঁচবো মা? আমার চিন্তা ছেড়ে তুই নিজের জন্য একটা কিছু ভাব" মুমূর্ষ বাবার কথাগুলো মিথির কাছে প্রলাপ মনে হয়েছিল। ছুটে যায় ডাক্তারবাবুর চেম্বারে, স্যার! বাবার অপেরাশনটা করুন, আমার কিছু গয়না আছে আমি বিক্রি করে আপনার টাকা শোধ দেব। প্রত্যুত্তরে ডাক্তারবাবু জানায়, তিনি টাকা ছাড়া অপেরাশন করবেন না, আর যদি বাবার সুস্থতা দেখতে চান তবে ডাক্তারবাবুর গৃহদাসী হয়ে থাকে হবে। মিথি বাবার প্রাণ চেয়ে ডাক্তারবাবুর কু-সঙ্গতি মেনে নেয়, ডাক্তার অপেরাশন করতে যান ঠিকই কিন্তু, মিথির সাথে ঘনিষ্ঠ আচরণের পর। সারাদিন খিদের জ্বালায় মিথি অসুস্থ হয়ে পড়ে, বাবাকে বাঁচানোর স্বপ্ন দেখে কবে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, নার্সের ডাকে ক্লান্ত শরীর জেগে ওঠে, "মিথি তোমার বাবার শেষরক্ষা করা গেলোনা", মাটির পুতুলের মতই স্বপ্ন গুড়িয়ে গেলো মিথির। স্বপ্ন দেখেছিল সে বাবার সুস্থতা, তার জন্য নিজের পরিশ্রমকে মেনে নিয়ে রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছে সে, ঋণের বোঝা কাঁধে তুলেছে, অবশেষে নিজের সুশ্রী শরীরের বলিদান ওই কুরুচিসম্পন্ন ডাক্তারের কাছে দিতে হয়েছে। শুধু একটা স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে - আজ ৩ মাস বাবার মৃত্যু, ভবঘুরে মিথি নিজের ভারসাম্য হারিয়েছে, পরনে একটা শার্ট তার পকেটে একটা ছবিতে 'মিথি আর মৃত মনোরঞ্জন বাবু'। 

সমাজের পটভূমিতে একটা স্বপ্ন তাদেরই মানায় যাদের মানসিকতাগুলো উচিৎ বোধ হারিয়ে ফেলে, তাদের স্বপ্নগুলোই আকস্মিক পূর্ণতা পায় যারা পাপের উপর পাপ করতে থাকে। চেতনার আজ বড্ড অভাব, নৃশংস যুগে শাকাহারি জীবজন্তুর সংখ্যা তীব্রমাত্রায় বেড়েছে। সময়ের ক্যানভাসে একটা সুন্দর স্বপ্ন বোবার মত নিস্তেজ হয় কেমন ভাবে তার প্রত্যক্ষ উদহারণ ডাউন শিয়ালদাহ ব্যারাকপুর লোকাল থাকল - সত্যি স্বপ্ন আবার কী, মিথির ভারসাম্য হয়ে চলার পথে ব্যাঙ্গাত্মক 'রক্ত' জানান দিলো।


(কাল্পনিক কাহিনী, বাস্তবের অনুকরণ) 


অনুগ্রহ করে কপি করবেন না, স্বপ্রমান ধরা পড়লে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

কোনো অভিযোগ/মতামত থাকলে ক্লিক করুন।